রাঙামাটি রাজবনবিহারে লাখো পুণ্যার্থীর অংশগ্রহনে শেষ হলো ২ দিনব্যাপী ৪০ তম কঠিন চীবর দান উৎসব। এই উৎসবকে ঘিরে গত দুইদিন রাঙামাটি শহর ছিল উৎসবের নগরী। ধর্মীয় উৎসব হলেও পুরো আয়োজনটি পরিণত হয় পাহাড়ী-বাঙ্গালীর মিলন মেলায়। রাজবনবিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকর মহাস্থবিরের দেশনার মাধ্যমে চীবর দান উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।
শুক্রবার দুপুর ১২ টা থেকে রাজবন বিহারের মাঠের বিশাল এলাকাজুড়ে শুরু হওয়া বর্ণাঢ্য বস্ত্র ও কল্পতরু শোভাযাত্রা মুহুর্মুহু আনন্দ ধ্বনি এবং উৎসবের জোয়ার প্রকম্পিত করে। ভোর থেকেই একেএকে জড়ো হতে থাকে পূণ্যার্থীরা।
প্রয়াত বনভান্তের শিয্যবর্গ ও অনুত্তর ভিক্ষু-সংঘ অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত হলে ভক্তদের সাধু..সাধু..সাধু কন্ঠধ্বনিতে সমগ্র আশপাশ এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বেলা আড়াইটায় দানযজ্ঞের প্রথম পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ভক্তদের পঞ্চশীল গ্রহণ। পরে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হয় সংঘদান, অষ্ট পরিস্কার দান, বুদ্ধমুর্তি দান, ২৪ ঘন্টার মধ্যে তৈরী পূণ্যার্থীদের কঠিন চীবর দান উৎসর্গ। বিকেলে সমবেত পুন্যার্থীদের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় দেশনা দেন বৌদ্ধধর্মীয় অন্যতম গুরু মহামতি বনভান্তের প্রধান শিষ্য শ্রী প্রজ্ঞালংকর মহাস্থবির।
এসময় অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন-শিল্পমন্ত্রী দীলিপ বড়–য়া, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামাল, পৌর মেয়র সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ভুট্টো, চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়,পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রনালয়ের সাবেক উপমন্ত্রী মনিস্বপন দেওয়ান,জেলা বিএনপির সভাপতি এডভোকেট দীপেন দেওয়ান,বিএনপি নেতা মনীষ দেওয়ান,রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের কর্মকর্তাসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ।
১৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় সুতা কাটা থেকে বুননের মাধ্যমে শুরু করা চীবর তৈরি শেষে ১৫ নভেম্বর শুক্রবার বিকাল ২টা ৫০ মিনিটে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের রাজবনবিহারের আবাসিক প্রধান শ্রী প্রজ্ঞালংকর মহাস্থবিরকে চীবর উৎসর্গ করার মাধ্যমে দান কার্য সম্পাদন করা হয়। এরপর শুরু হয় আনুষ্ঠানিকভাবে চীবর দান অনুষ্ঠান ।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদানকালে শিল্পমন্ত্রী দীলিপ বড়–য়া বলেন, আমরা সকলে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাই। সমাজের মধ্যে যে অহিংসা হানাহানি কুসংস্কার চলছে তা সকলকে বন্ধ করতে হবে। চিত্তকে পরিশুদ্ধ করার জন্য এবং এবং ধর্মীয় সুধা পান করার জন্য সকলকে একে অপরের প্রতি সহনশীল মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। শ্রদ্ধেয় বনভন্তের বদৌলতে তার এই অনবদ্য কর্মযজ্ঞ আমাদের সকলের মাঝে প্রেরনা যুগিয়েছে।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদানকালে রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেন, এ কঠিন চীবর দানের মধ্য দিয়ে শান্তির প্রতি শ্রদ্ধা ও গভীরতা বৃদ্ধি পায়। সকলেই সংকল্পবদ্ধ হয়ে সকল প্রকারের হানাহানি ও হিংসার অবসানের মধ্য দিয়ে যাতে এ অঞ্চলে ও সারাদেশে সত্যিকার অর্থে জনমূখী ও পরিবেশমূখী উন্নতি আনতে পারি সে লক্ষ্যে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। দেবাশীষ রায় এই কঠিন চীবর দানের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের জুম চাষ প্রথার মাধ্যমে জুমের তুলা থেকে সুতা ও চীবর তৈরী হয় এবং বৌদ্ধ ধর্মীয় কৃষ্টি সংরক্ষন হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যর মধ্যে বক্তব্য রাখেন রাজবন বিহার উপাসক উপাসিকা পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি গৌতম দেওয়ান,ভারতের দিল্লী থেকে আগত পুর্ন্যাথী কুমার সিং, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুভেচ্ছা বাণী পাঠ করেন পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা,বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শুভেচ্ছা বানী প্রদান করেন জেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান।
প্রসঙ্গত, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে ভগবান গৌতম বুদ্ধের উপাসক বিশাখা ২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা কেটে বৌদ্ধ পুরোহিতদের ব্যবহার্য চীবর তৈরি করে দানকার্য সম্পাদন করেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে এবং বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরুদের প্রতি নিজেদের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্পন কার অংশ হিসেবেই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৌদ্ধরা এই রীতি পালন করে আসছে। রাঙামাটি রাজবন বিহারে ১৯৭৭ সালে এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে বনভান্তে বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে সর্বপ্রথম কঠিন চীবর দান প্রচলন করেন। এর আগে রাঙামাটি জেলার তিনটিলা বৌদ্ধ বিহারের ১৯৭৩ সালে এই কঠিন চীবর দান করা হয়।
প্রত্যেক বছর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বর্ষাবাস শেষে আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমায় বৌদ্ধরা এই মহাপূন্যানুষ্ঠান কঠিন চীবর দানোৎসব পালন করে। প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী অংশ নেন
কঠিন চীবর দান উপলক্ষে তিন পার্বত্য জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত অগণিত পুণ্যার্থী ও দর্শণার্থীর ভিড়ে পরিণত হয় রাজবনবিহারের বিশাল এলাকা। প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়েরএ বিশাল মহাসমাবেশ সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় সার্বজনিন প্রদীপ পূজা। সন্ধ্যায় সার্বজনীন প্রদীপ পূজার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের বর্নাঢ্য সব আয়োজন।
বনভান্তের প্রতি সন্মানপ্রর্দশন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাণঘাতি হানাহানি বন্ধ হউক।
সকল মানুষ যেন সম্প্রীতিতে বাস করে এই কামনা রইল সবার প্রতি।