পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জনগোষ্ঠির অহংকারখ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউকেচিং বীর বিক্রম এখন লড়ছেন দারিদ্রতা এবং মৃত্যুর সাথে। স্বাধীনতার ৪২ বছরেও জীবনের হিসাব নিকাশ মিলাতে না পেরে অঝরে কাদঁছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় পড়ে থেকেও স্বাধীনতা যুদ্ধের এই লড়াকু সৈনিককে আজও ভাবতে হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের দুবেলা আহার জুটবে কি করে, তা নিয়ে। অভাব তার স্বাধীনতার স্বপ্নকে তিরোহিত করেছে বহুআগেই।
বান্দরবান জেলা শহরের উজানীপাড়ায় ১৯৩৩ সালে এই বীরের জম্ম। পিতার নাম মৃত বাইশাউ মার্মা। লেখাপড়া তেমন করতে পারেননি ইউকেচিং বীর বিক্রম। কিন্তু তাঁর মধ্যে দেশও জাতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার প্রত্যয় ছিল বাল্যকাল থেকেই। সেই লক্ষে ১৯৫২ সালে যোগদেন পাকিস্থান রাইফেলস ব্যাটালিয়ানে (ইপিআর)। ১৯৭১ সালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৯ মাস রনাঙ্গণে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ করেছেন। এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত হন। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ী জনগোষ্ঠীদের মধ্যে এই খেতাব অর্জনকারী একমাত্র গর্বিত সন্তান তিনি।
রণাঙ্গনে বীরবেশে দেশকে শক্রুর আক্রমণ থেকে মুক্ত করতে পারলেও দারিদ্রতার কষাঘাত থেকে তিনি তার পরিবারকে এখনো মুক্ত করতে পারেনি। সামান্য পেনশনের টাকায় প্রচন্ড অভাবের মধ্যে চলছে তার সংসার। তার দুই ছেলে বান্দরবান বাজারে লাকড়ি বিক্রি করে পিতার সংসারে স্বল্প পরিমাণ খরচের যোগান দিয়ে থাকেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে অতি সাধারণ ঘরে। সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবান সেনা রিজিয়ন এবং জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে একটি বসতঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রি কৃর্তৃক প্রদত্ত মেডেলও চুরি হয়ে গেছে বলে জানান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সংসারের অভাবের বোঝা টানতে গিয়ে তিনি ইতোমধ্যে ২ একর পাহাড়ি ভূমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন বসতবাড়ি আর সামান্য পাহাড়ি ভূমিই তার সম্বল। অভাব তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী হলেও তিনি ব্যক্তিত্বকে বিকিয়ে দেননি । সাহায্যের হাত পাতেননি কারো কাছে। বয়সের ভারে ন্যূজ ৮০ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন একটাই। এই দেশে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা পাবেন সরকারী পৃষ্টপোষকতা।
একজন বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও তিনি ইপিআর ও বিজিবি হকি খেলোড়ার হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। তিনি বিজিবি’র হকি কোচ ছিলেন বহুদিন। জেলা শহরের লাঙ্গীপাড়ায় তাঁর ঘরে বসে বীরমুক্তিযোদ্ধা ইউকেচিং বীর বিক্রম স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ৯ মাসের স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম এই দেশকে শক্রু মুক্ত করতে। একটি স্বাধীন পতাকা বিশ্বের বুকে বাঙালী জাতির পরিচয় বহন করবে এটি ছিল লক্ষ্য। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সর্বক্ষেত্রে মুক্তি আসবে এই ছিল প্রত্যয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইপিআর এর একজন নায়েক হিসেবে ইউকেচিং রংপুর জেলার হাতিবান্ধা গ্রামের বিওপিতে কর্মরত ছিলেন। দেশের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক দেখে বিওপিতে অবস্থানকারী ৯ বাঙ্গালী সৈনিককে নিয়ে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের সিন্ধান্ত নেন। তিনি আরও বলেন, দেশ স্বাধীন হলেও আমরা সেই লক্ষে পৌছাতে পারিনি এখনো। অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে। এখনো অবিশ্বাস ও অপরের প্রতি হিংসা পোষণ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারেনি। ইতিহাস বিকৃতি করে মুক্তিযোদ্ধাদের কলংকিত করার পাঁয়তারা চলছে।
বীরবিক্রম ইউকেচিং দুঃখ করে বলেন, স্বাধীনতার পর সেই পুরনো অপশক্তিকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। তাদের কুট কৌশল ও বুদ্ধিমত্তাকে সরকারী ভাবে পৃষ্টপোষকতা করা হয়েছে। লজ্জাজনক এই পরিস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করতে হচ্ছে নিরূপায় হয়ে।
ইউকেচিং বলেন, স্বাধীনতার ৪২ বছরেও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাতে শিখেনি এই জাতি। মুক্তিযোদ্ধারের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান ও জাতির অহংকার বলে গালভরা বুলি ছুড়লেও সরকার স্বীকৃত চাকুরীর ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটা সংরক্ষণ করা হয়না। তবে জীবনের শেষবেলায় এসে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইনীপন্থায় শাস্তি নিশ্চিত করা শুরু হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন একাত্তরের বিজয়ী এই যোদ্ধা।