পার্বত্য চট্টগ্রাম তো বিভক্ত হয়নি। বিশাল সবুজ পাহাড় সর্বত্র। বুনো প্রাণীর ভয়,সুবিশাল পাহাড়,সুবিস্তৃত জলরাশি আর দুর্গমতার কারণে এই অঞ্চলে মানুষের বসবাস ও ঘনত্ব দেশের অন্যান্য জায়গার চেয়েও অনেক কম। এমন বৈরি সময়ে আজ থেকে ঠিক ১২২ বছর আগে যখন দেশের অনেক সমৃদ্ধ সমতলেও গড়ে উঠেনি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,সেই কঠিন সময়ে রাঙামাটি শহরের ( ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের কারণে ডুবে যাওয়া শহর) এর পাশের এক সুউচ্চ পাহাড়ে স্থাপিত হয় রাঙামাটি উচ্চ বিদ্যালয়। যা পরে কালের বিবর্তনে রাঙামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় নামেই পরিচিতি লাভ করে। মজার ব্যাপার,১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের কারণে পুরো রাঙামাটি শহর,শহরের সকল স্থাপনা,এমনকি চাকমা রাজবাড়ীও পানিতে তলিয়ে গেলেও সুউচ্চ পাহাড়ে অবস্থানের কারণে শুধু যে সামান্য কয়েকটি স্থাপনা বেঁচে যায় তার অন্যতম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৯৮ সালের ১৬ ও ১৭ মে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সাড়ম্ভরে তার প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপন করে। শহরের ডিসি বাংলো এলাকায় মনোরোম প্রাকৃতিক পরিবেশে কাপ্তাই হ্রদের পাড়ের সুউচ্চ পাহাড়ে প্রায় ১৩.১৬ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত স্কুলটির ক্যাম্পাস।
স্কুলের ইতিহাস
পার্বত্য চট্টগ্রাম পৃথক জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬০ সালে। তখন পার্বত্য এই জেলার সদর দপ্তর ছিলো বর্তমান কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোণায়। ১৮৬২ সালে চন্দ্রঘোণায় প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেই সময়ও এই প্রাথমিক স্কুলেই ছিলো আবাসিক সুবিধা,আর এই কারণ স্কুলটিকে বোডিং স্কুলও বলা হতো। সেই সময় এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আব্দুল হামিদ মিয়া। স্কুলটি চালু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে এখানে দুইটি পৃথক শাখা খোলা হয়। একটি বার্মিজ ও অন্যটি চাকমা। তৎকালীন সময়ে এই স্কুলে বাংলা,ইংরেজি এবং বার্মিজ ভাষা শেখানো হতো। ১৮৬৯ সালে জেলা সদর দপ্তর চন্দ্রঘোণা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে রাঙামাটির পানিতে ডুবে যাওয়া মূল শহরে চলে আসে। সেই সাথে বোর্ডি স্কুলটির নামও পরিবর্তিত হয়ে ‘রাঙামাটি সরকারি বোডিং স্কুল’ নামধারণ করে এবং ১৮৭৩ সালে স্কুলটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ইংরেজি স্কুলে রূপ নেয় এবং ‘রাঙামাটি সরকারি মিডল ইংলিজ স্কুল’ নামে পরিবর্তিত হয়। সেসময় সরকারিভাবে স্কুলটির জন্য ৫০০০ রূপী বার্ষিক অনুদান ছিলো এবং এই টাকার বৃহৎ অংশই খরচ হতো স্কুলের বোডিং এর জন্যই। সেই সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন রাম কমল দাশ। ১৮৯০ সালে স্কুলটি আবারো নাম পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান ‘রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়’ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই সময় এই স্কুলের প্রথম ব্যাচে মোট বাইশজন শিক্ষার্থী ছিলো,যার মধ্যে ৯ জন ছিলো পাহাড়ী। আর ৯ পাহাড়ী শিক্ষার্থীর মধ্যে পরবর্তীকালের চাকমা রাজা ভূবন মোহন রায়ও ছিলেন। এই স্কুলের প্রথম পাহাড়ী ছাত্রী ছিলেন রেনু দেওয়ান আর এই স্কুল থেকে প্রথম এন্ট্রান্স পাস করা পাহাড়ী মহিলা হলেন মনোরোমা দেওয়ান। এই স্কুলের দ্বিতীয় ছাত্রী ছিলেন বকুল বালা চাকমা,যিনি পরে এই স্কুলেরই শিক্ষিকা ছিলেন। তার সন্তান মনিস্বপন দেওয়ান পরে পার্বত্য উপমন্ত্রী হন এবং স্বামী শান্তিময় দেওয়ানও উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন।
মজার ব্যাপার হলো,পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার ৪১ বছর পর ১৯৩১ সালে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে দ্বিতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।
১৯৪৭ সালে এই স্কুলের ছাত্র ত্রিপুরা কান্ত চাকমা অবিভক্ত বঙ্গদেশে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে,১৯৫৩ সালে আরেক ছাত্র জীবন গাঙ্গুলি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। ১৯৫৪ সালে স্কুলের শিক্ষার্থী অমলেন্দু বিকাশ চাকমা এবং ১৯৫৭ সালে অমরেন্দ্র লাল খীসা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে মেধা তালিকায় বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করে। সাফল্যের এই ধারা বহমান থাকে স্বাধীন বাংলাদেশেও। এখনো ভালো ফলাফল এবং সামগ্রিক পরিবেশ বিবেচনায় এইটিই পার্বত্য চট্টগ্রামের সেরা মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।