পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৬ বছর পরও চুক্তি বাস্তবায়নের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে শেষ হয়নি বিতর্কের। চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার এবং জনসংহতি সমিতির বক্তব্য পুরোই বিপরীতমুখি। সরকারের পক্ষে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার চুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে দাবী করলেও সন্তু লারমার দাবী গত ১৬ বছরেও চুক্তির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদারের দাবি- চুক্তি সাক্ষরের পর আঞ্চলিক পরিষদ গঠন,জেলা পরিষদ গঠন,পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় স্থাপন,ভারত প্রত্যাগত ১২,২২২ পরিবারকে নিজ নিজ ভূমিতে পূনবার্সন,১৯২৬ জনসংহতি সদস্যকে পুনবার্সন করা,তাদের সকল মামলা নিষ্পত্তি করা এবং প্রত্যাহার করা,যারা চাকুরীতে ছিলো তাদের চাকুরীতে পূনর্বাহল করা,চাকুরীতে কোটা সংরক্ষণ,জনসংহতির সদস্যদের চাকুরী এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি,চাকুরীতে কোটা সংরক্ষনসহ উল্লেখযোগ্য অনেকগুলো বিষয়ই বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভার বরাত দিয়ে বলেন,চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্যে ইতোমধ্যেই ৪৮ টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে বলে কমিটির যে সভায় সন্তোষ প্রকাশ করা হয়,সেই সভায় সন্তু লারমা নিজেও উপস্থিত ছিলেন।
তিনি আরো বলেন-‘আমাদের মূল যে সমস্যা হলো তা হলো ‘ভূমি সমস্যা’। এই সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ শুরু করেছি,ভূমি কমিশন গঠন করেছি। ভূমি সমস্যা সমাধান না হওয়ার কারণে আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু পূনর্বাসন এবং ভারত প্রত্যাগত শরনার্থীদের কিছু সংখ্যককে নিজ ভূমিতে পুনর্বাসন ব্যহত হচ্ছে।
চুক্তি সাক্ষরের পর আঞ্চলিক পরিষদ গঠন,জেলা পরিষদ গঠন,পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় স্থাপন,ভারত প্রত্যাগত ১২,২২২ পরিবারকে নিজ নিজ ভূমিতে পূনবার্সন,১৯২৬ জনসংহতি সদস্যকে পুনবার্সন করা,তাদের সকল মামলা নিষ্পত্তি করা এবং প্রত্যাহার করা,যারা চাকুরীতে ছিলো তাদের চাকুরীতে পূনর্বাহল করা,চাকুরীতে কোটা সংরক্ষণ,জনসংহতির সদস্যদের চাকুরী এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি,চাকুরীতে কোটা সংরক্ষনসহ উল্লেখযোগ্য অনেকগুলো বিষয়ই বাস্তবায়িত হয়েছে।চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্যে ইতোমধ্যেই ৪৮ টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে।…দীপংকর তালুকদার
তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান এবং জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা দীপংকরের বক্তব্যের সাথে একমত নন। তার দাবি গত ১৬ বছরেও পার্বত্য চুক্তির উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতিই হয়নি। কোন সরকারই চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দেখায়নি বলে প্রায়ই বিভিন্ন সভা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তিনি। তার অভিযোগ,পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদকে তার যে ক্ষমতা তা দেয়া হয়নি,যেসব বিভাগ হস্তান্তর করার কথা তা করা হয়নি। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাত্র ৩৫ টি সেনা ক্যাম্প এবং কাপ্তাই বিগ্রেড প্রত্যাহার ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোন কাজ হয়নি বলেও অভিযোগ সন্তু লারমার।
চুক্তির ১৬ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত জনসংহতি সমিতির রিপোর্টে বলা হয়েছে,জেলা পরিষদসমূহকে অধিকতর শক্তিশালীকরণের নিমিত্তে চুক্তির মাধ্যমে আরো নতুন ১২টি বিষয়সহ মোট ৩৩টি বিষয় পরিষদের নিকট হস্তান্তরের বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এখনো আইন-শৃঙ্খলা,ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, মাধ্যমিক ও মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা, রক্ষিত নয় এমন বন ও পরিবেশ, পর্যটন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় হস্তান্তর করা হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদের কার্যবিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়নি। স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন নিয়ে সরকারের কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছেনা বলেও অভিযোগ তাদের। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরীতে পাহাড়ীদের অগ্রাধিকার দিয়ে স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়োগের বিষয়টিও লংঘিত হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।
জনসংহতি আরো অভিযোগ করেছে-ভারতপ্রত্যাগত শরনার্থীদের মধ্যে ৯,৭৮০ পরিবার তাদের তাদের জমি ফেরত পায়নি, প্রত্যাগত ৮৯০ পরিবার হালের গরুর টাকা পায়নি,ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত করে পাঠানো হলেও তা আজ অবধি সংশোধিত হয়নি, সরকারী চাকুরীতে ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাহাড়ী ছাত্রছাত্রীদের জন্য কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে তা অনেকক্ষেত্রেই কার্যকর হয়না,জনসংহতি সদস্যদের ৭২০টি মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও আজ অবধি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মামলা প্রত্যাহারের গেজেট জারী হয়নি। এছাড়া এখনো ১১৯টি মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।
ভারতপ্রত্যাগত শরনার্থীদের মধ্যে ৯,৭৮০ পরিবার তাদের তাদের জমি ফেরত পায়নি, প্রত্যাগত ৮৯০ পরিবার হালের গরুর টাকা পায়নি,ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত করে পাঠানো হলেও তা আজ অবধি সংশোধিত হয়নি, সরকারী চাকুরীতে ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাহাড়ী ছাত্রছাত্রীদের জন্য কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে তা অনেকক্ষেত্রেই কার্যকর হয়না,জনসংহতি সদস্যদের ৭২০টি মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও আজ অবধি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মামলা প্রত্যাহারের গেজেট জারী হয়নি। এছাড়া এখনো ১১৯টি মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।..জনসংহতি সমিতি
জনসংহতি সমিতি জানিয়েছে, সমিতির ১৯৬৭ জনকে ৫০ হাজার করে অর্থ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৬৭২ জনকে পুলিশ কনষ্টেবল ও ১১ জনকে সার্জেন্ট পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। জনসংহতি সমিতির সদস্যের মধ্যে ৬৪ জনকে চাকুরীতে পুনর্বহাল করা হয়েছে জানিয়ে বলেছে- সদস্যদের দাখিলকৃত ১৪২৯টি আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প এখনো সরকার ঝুলিয়ে রেখেছে। চুক্তি মোতাবেক ৫ শতাধিক সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৬৬ টি সেনা ক্যাম্প ও একটি বিগ্রেড প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তবে এর মধ্যে জনসংহতি সমিতির সদস্যদের সকল মামলাই প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার। আর আভ্যন্তরীণ উদ্বান্তু এবং ভারত প্রত্যাগতদের অবশিষ্টদের নিজ ভূমিতে পূনর্বাসন প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন-বিষয়টি ভূমি সমস্যা সমাধানের সাথে সম্পর্কিত। তাই ভূমি কমিশন কাজ শুরু করলে এইগুলোর সমাধান হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি ও সাবেক স্থানীয় সরকার পরিষদ চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান বলেন-পার্বত্য চুক্তি হয়েছে কিন্তু চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তির স্বার্থে এই চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরী মন্তব্য করে তিনি বলেন- এই সরকার যেহেতু চুক্তি করেছে তাই সরকারের কাছেই বাস্তবায়নে দাবী আমাদের বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি সরকারকে চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন-আঞ্চলিক পরিষদের কার্যবিধিমালা প্রণয়ন,আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তু এবং ভারতপ্রত্যাগতদের পুণর্বাসন,ভূমি সমস্যার সমাধান অত্যন্ত জরুরী বিষয়। এগুলোর সমাধানের উপরই নির্ভর করছে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন।