পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা দেশের সর্ব বৃহৎ বৌদ্ধ মন্দির রাঙামাটির রাজ বন বিহারে বৃহস্পতিবার থেকে প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুদিন ব্যাপী দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব শুরু হয়েছে।
৪১ তম কঠিন চীবর দানোৎসবের প্রথম দিনে রাজ বন বিহারের পাশে বেইন ঘরে পূণ্যবতী উপাসিকা বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে ২৪ ঘন্টার মধ্যে চরকায় সূতা কাটা থেকে কাপড় তৈরীর জন্য বেইন ঘর উদ্বোধন করেন চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, চরকায় সুতা কাটা উদ্বোধন করেন নতুন চাকমা রানী ইয়ান ইয়ান।
এ উৎসবকে ঘিরে রাঙামাটি শহর উৎসবের নগরীতে পরিনত হয়েছে। শুক্রবার তৈরীকতৃ চীবর ধর্মীয় অনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ভিক্ষু সংঘের উদ্দেশ্য দান করা হবে।
বেইন ঘর ও চরকায় সূতা কাটা উদ্বোধনকালে চাকমা চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেন, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সুতা কেটে বেইন বুনে ভিক্ষু সংঘকে প্রদান করা হয়। বিশাখা প্রবর্তিত আড়াই হাজার বছরের পুরনো যে জুম এবং বয়নের যে ঐতিহ্য আছে সেটাকে আমরা সমাদর করছি। ৩১ অক্টোবর শুক্রবার সকাল ছয়টায় বুদ্ধ পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনের কার্যক্রম শুরু হবে।
শুক্রবার সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হবে দেব-মানবের তথা সকল প্রাণীর হিতার্থে ধর্মদেশনা। ধর্মদেশনায় উপস্থিত থাকবেন রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্র্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির। দুপুর একটায় শোভাযাত্রা সহকারে কঠিন চীবর ও কল্পতরু মঞ্চে আনয়ন হবে। পঞ্চশীল গ্রহণের পর দুপুর আড়াইটায় বনভন্তের মানব প্রতিকৃতির উদ্দেশ্যে কঠিন চীবর উৎসর্গ হবে। এসময় বনভান্তের প্রতিনিধি হিসেবে এ চীবর গ্রহণ করবেন আবাসিক প্রতিনিধি শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণভাবে রাঙামাটি রাজবন বিহারে প্রতিবছর এ দানোৎসবের আয়োজন করা হয়।
এই অনুষ্ঠানকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালনের জন্য ইতোমধ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে রাজবন বিহার উপাসক- উপাসিকা পরিষদ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের সাথেও এ নিয়ে উপাসক- উপাসিকা পরিষদের কয়েকদফা বৈঠকের পর নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সহ-সভাপতি গৌতম দেওয়ান জানান, এ বছর ৪১তম দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আশা করবো বরবারের মতো এবারও সুষ্ঠুভাবে দান অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে পারবো। তিনি আরো জানান, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়ে শুক্রবার ভিক্ষু সংঘের কাছে চীবর দানোৎসর্গের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হবে। সকল পূূণ্যার্থী, দর্শনার্র্থী ও প্রশাসনের সর্বস্তরের মানুষের কাছে অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। এদিকে, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও রাজবনবিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সহ-সভাপতি নিরূপা দেওয়ান বলেন, কঠিন চীবর দানের মাধ্যমে যে পূর্ণ কাজটি করছি তার পাশাপাশি এখানকার আদিবাসীদের বয়ন শিল্পের ঐতিহ্য আছে সেটিকে যুগ যুগ ধরে রাখার একটা প্রয়াস চলছে।
পাহাড়ী নারী তুনা চাকমা বলেন, বুদ্ধ নারী বিশাখা আড়ইিহাজার বছর পুর্বে জুম থেকে তুল নিয়ে এসে এবং তুলা থেকে সুতা তৈরী করে কঠিন চীবর বানিয়েছেন সেভাবে আমরাও ২৪ ঘন্টার মধ্যে চীবর (বস্ত্র) তৈরী করে ভিক্ষু সংঘকে দান করবো। এবার ১৫৪ টি বেইন ঘরে ৬১৬জন পাহাড়ী নারী ২৪ ঘন্টায় তৈরী করবে এ চীবর। এছাড়া সুতা লাঙ্গানো, সিদ্ধ, রং, টিয়ানো, শুকানো, তুম করা, নলী করা, বেইন টানার কাজে আরো শতাধিক পুরুষ কর্মী অংশগ্রহণ করছে। পরদিন সকাল ৬টা থেকে শুরু করে দুপুুর ১২টা পর্যন্ত চীবর সেলাই চলবে।
এদিকে উৎসব উপলক্ষে রাজবন বিহার এলাকায় বিশাল মেলা বসেছে। মেলা প্রাঙ্গণে সহস্রাধিক স্টলে সারাদেশ থেকে কুটির ও হস্তশিল্পের পণ্যের পসরা নিয়ে লোকজন এ মেলায় অংশ নিয়েছে।
উল্লেখ্য, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে ভগবান গৌতম বুদ্ধের উপাসক বিশাখা ২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা কেটে বৌদ্ধ পুরোহিতদের ব্যবহার্য চীবর (বস্ত্র) তৈরি করে দানকার্য সম্পাদন করার পদ্ধতিতে এ কঠিন চীবর দান প্রবর্তন করেন। প্রত্যেক বছর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বর্ষাবাস শেষে আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমায় বৌদ্ধরা এই মহাপূন্যানুষ্ঠান কঠিন চীবর দানোৎসব পালন করে।
প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে ভক্ত অনুরাগী অংশ নিচ্ছেন। রাজবন বিহারে ১৯৭৪ সালে এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে বনভান্তে বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে সর্বপ্রথম কঠিন চীবর দান প্রচলন করেন। এর আগে রাঙামাটি জেলার তিনটিলা বৌদ্ধ বিহারের ১৯৭৩ সালে এই কঠিন চীবর দান করা হয়। বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী কঠিন চীবর দান ২৪ ঘন্টার মধ্যে সুতা থেকে কাপড় তৈরি করে একমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে বনভান্তের অনুসারী বৌদ্ধ সম্প্রদায় সম্পাদন করে।
এদিকে রাজবনবিহারে দুদিনব্যাপী কঠিন চীবর দান উপলক্ষে পুলিশ বিভাগ থেকে নেয়া হয়েছে বাড়ত্তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আযাদ বলেন, কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য ব্যাপকভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বনবিহারের কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানের জন্য ৫০০ পুলিশ,পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও বনবিহারের নিজস্ব ৭শ স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত আছে।